কৈশর জীবনঃ ইসলামী বিশ্বাসমতে, এর কয়েকদিন পরই একটি কালজয়ী অলৌকিক ঘটনা ঘটে তার সাথে। একদিন বিবি হালিমার পুত্র ও শিশু মুহাম্মদ মাঠে মেষ চড়াচ্ছেন এতে কয়েকজন মিলে খেলছেন কিন্তু শিশু মুহাম্মদ খেলছেন না বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছেন। কিছুক্ষণ পর অপরিচিত কয়েকজন লোক এসে শিশু মুহাম্মদকে জমিনে শুয়িয়ে বুক চিরে কলিজার একটি অংশ বের করে তা জমজম কূপের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে স্থাপন করে দেয়া হয়। এই দেখে অন্যান্য শিশুরা ভয়ে দৌড়ে গিয়ে পুরো ঘটনা হালিমা সাদিয়াকে বলল, সাথে হযরত হালিমা রাঃ ঘটনাস্থলে পৌঁছান কিন্তু এসেই দেখেন শিশু মুহাম্মদ সুস্থভাবে বসে আছেন। ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে সক্কে সিনা বা সিনা চাকের ঘটনা হিসেবে খ্যাত।
এই ঘটনার পরই হযরত হালিমা শিশু মুহাম্মাদকে মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। ছয় বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের সাথে কাটান। এই সময় একদিন মা আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদিনায় যাবেন। সম্ভবত কোনো আত্মীয়ের সাথে দেখা করা এবং স্বামীর কবর জিয়ারত করাই এর কারণ ছিল। মা আমিনা ছেলে, শ্বশুর এবং দাসী উম্মে আয়মনকে নিয়ে ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদিনায় পৌঁছেন। তিনি মদিনায় একমাস সময় অতিবাহিত করেন। একমাস পর মক্কায় ফেরার পথে আরওয়া নামক স্থানে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই দাফন করা হয়। মাতার মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মুত্তালিব শিশু মুহাম্মাদকে নিয়ে ধীরে মক্কায় পৌঁছেন। এর পর থেকে দাদাই মুহাম্মাদের দেখাশোনা করতে থাকেন। মুহাম্মদের বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন তখন তার দাদাও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মৃত্যুর আগে তিনি তার পুত্র আবু তালিবকে ডেকে নাতি শিশু মুহাম্মদের দায়িত্বভার দিয়ে যান।
চাচা আবু তালিব ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার সিরিয়া সফরে যেতেন। মুহাম্মাদের বয়স যখন ১২ বছর তখন তিনি চাচার সাথে সিরিয়া যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেন। প্রগাঢ় মমতার কারণে আবু তালিব আর নিষেধ করতে পারলেন না। যাত্রাপথে বসরা পৌঁছার পর কাফেলাসহ আবু তালিব তাঁবু ফেললেন। সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল। শহরটিতে জারজিস নামে এক খ্রিস্টান পাদ্রী ছিলেন যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি তার গির্জা হতে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারী করেন। এ সময় তিনি বালক মুহাম্মাদকে দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেন। ফুজারের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন নবীর বয়স ১৫ বছর। এই যুদ্ধে তিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। কিন্তু তাঁর কিছু করার ছিল না। সে সময় থেকেই তিনি কিছু একটি করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন।
বিবাহ ও নবীপত্নীগণ: মক্কা থেকে মদিনায় ইতিহাসখ্যাত হিজরতের মাত্র তিন বছর আগে হযরত খাদিজা রাঃ এর ইন্তেকাল হয়। এ সময় নবী করিম (সা:) এর বয়স ছিল ৪৯ বছর। হযরত খাদিজা রাঃ এর মৃত্যু পর্যন্ত তিনিই ছিলেন নবীজি (সা:) এর একমাত্র স্ত্রী। হযরত খাদিজা রাঃ এর মৃত্যুর পর তিনি একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করেন। এঁদের অনেকেই ছিলেন বিধবা বা যুদ্ধে স্বামীহারা অথবা স্বামী পরিত্যক্তা কিংবা দুস্থ। আবার কোনো বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় আল্লাহর সরাসরি নির্দেশে। উম্মাহাতে মু'মিনিনরা হলেন-
এক.
হযরত খাদীজা মাইছারার মুখে মুহাম্মাদের সততা ও ন্যায়পরায়ণতার ভূয়সী প্রশংসা শুনে অভিভূত হন। এছাড়া ব্যবসায়ের সফলতা দেখে তিনি তার যোগ্যতা সম্বন্ধেও অবহিত হন। এক পর্যায়ে তিনি মুহাম্মাদকে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি স্বীয় বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনব্বিহরের কাছে বিয়ের ব্যপারে তার মনের কথা ব্যক্ত করেন। নাফিসার কাছে শুনে মুহাম্মাদ বলেন যে তিনি তার অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানাবেন। মুহাম্মাদ তাঁর চাচাদের সাথে কথা বলে বিয়ের সম্মতি জ্ঞাপন করেন। বিয়ের সময় খাদীজার বয়স ছিল ৪০ আর মুহাম্মাদের বয়স ছিল ২৫। তিনিই ছিলেন নবী করিম (সা:)- এর প্রথম স্ত্রী। তিনি বিধবা তবে বিদুষী ও অভিজাত নারী ছিলেন। পবিত্র মক্কায় তিনি 'ত্বাহেরা'— অর্থাৎ পবিত্র নারী বলে পরিচিত ছিলেন। নবী করিম (সা:)- এর চেয়ে কমপক্ষে ১৫ বছরের বড় ছিলেন তিনি। নবুয়তের প্রথম জীবনে নবী (সা:)- এর দাওয়াতের কাজে তিনি বিশেষভাবে পাশে দাঁড়ান।
দুই.
হযরত সাওদা বিনতে জামআ রাঃ প্রথমে সাকরান ইবনে আমরের স্ত্রী ছিলেন। সাকরানের মৃত্যুর পর নবী (সা:)- এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
তিন.
হযরত আয়েশা রাঃ যিনি ছিলেন মুসলিম বিশ্বের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর রাঃ-এর কন্যা। কেবল হযরত আয়েশা রাঃ-ই কুমারী মেয়ে ছিলেন, যাঁদের সঙ্গে মহানবী (সা:)- এর বিয়ে হয়েছিল। নবী (সা:)- এর ওফাতের সময় হযরত আয়েশা রাঃ-এর বয়স ছিল মাত্র আঠারো বছর। নবী (সা:)- এর বহু হাদিস হযরত আয়েশা রাঃ-এর মাধ্যমে মানবজাতির কাছে পৌঁছেছে। তাঁর প্রখর মেধা ও স্মরণশক্তি এ কাজে সহায়ক হয়েছিল।
চার.
হযরত হাফসা রাঃ ছিলেন মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় খলিফা এবং অর্ধ জাহানের বাদশা হযরত ওমর রাঃ-এর কন্যা। হযরত হাফসা রাঃ প্রথম জীবনে হযরত উনাইস ইবনে হুজাইফা রাঃ-এর স্ত্রী ছিলেন। হযরত উনাইস রাঃ যুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর নবী (সা:) তাঁকে স্ত্রী হিসেবে বরণ করেন।
পাঁচ.
হযরত জয়নব বিনতে খুজাইমা রাঃ। তিনি মদিনায় নিঃস্বদের জননী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রথম জীবনে তাঁর বিয়ে হয়েছিল তোফায়েল ইবনে হারিছের সঙ্গে। তালাকপ্রাপ্ত হয়ে তোফায়েলেরই ভাই উবায়দাকে বিয়ে করেন তিনি। উহুদের যুদ্ধে উবায়দা শহীদ হন। পরে অসহায় জয়নবকে বিয়ে করেন নবী করীম (সা:)। কিন্তু বিবাহিত জীবনের ছয় মাসের মধ্যেই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায়।
ছয়.
হযরত উম্মে সালামা রাঃ। প্রথম জীবনে তাঁর বিয়ে হয়েছিল আবু সালামা রাঃ-এর সঙ্গে। উহুদের যুদ্ধে আবু সালামা রাঃ শহীদ হন। বিধবা উম্মে সালামাকে অবশেষে নবী (সা:) স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে নেন। ইতিহাসবিদরা বলেন, নবী (সা:)- এর স্ত্রীদের মধ্যে তিনিই সবার শেষে মৃত্যুবরণ করেন।
সাত.
হযরত জয়নাব বিনতে জাহাশ রাঃ। তিনি ছিলেন নবী (সা:)- এর ফুফাতো বোন। নবী (সা:) প্রথমে তাঁর এই বোনকে তাঁর পালকপুত্র হযরত জায়েদ রাঃ-এর সঙ্গে বিয়ে দেন। এই বিয়েতে গোড়া থেকেই জয়নাব রাঃ-এর আপত্তি ছিল। ফলে তাঁদের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। পরে তাঁদের পারিবারিক জীবনে বিচ্ছেদ ঘটে। হযরত জয়নাব রাঃ-এর আপত্তিতে এ বিয়ে সংঘটিত হওয়ায় এবং পরে বিচ্ছেদ ঘটায় নবী (সা:)- এর মনে কিছুটা অনুশোচনা আসে। এ থেকে জয়নাব রাঃ-কে নিজে বিয়ে করার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেও তৎকালীন আরবের কুসংস্কারের জন্য তা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। পরে পবিত্র কুরআনের সুরা আহযাবে আয়াত নাজিল হয়। সেখানে পালক ছেলে ও ঔরসজাত সন্তান সমতুল্য নয় বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কুসংস্কার নির্মূল করার উদ্দেশ্যে নবী (সা:)- এর মাধ্যমে সেই বিধান বাস্তবায়ন করে দেখানোর প্রয়োজন অনুভূত হয়। তখনই হযরত জয়নাব রাঃ-এর সঙ্গে নবী (সা:)- এর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
আট.
হযরত জুয়াইরিয়া রাঃ। তিনি একজন আরব গোত্রের সরদার হারিছের কন্যা ছিলেন। যুদ্ধে বন্দিনী হয়ে আসেন। মহানবী (সা:) যুদ্ধবন্দির সঙ্গে বিবাহে আবদ্ধ হন। উপহার হিসেবে গোত্রের সব বন্দি মুক্তি লাভ করে। তাঁর পিতা হারিছও ইসলাম গ্রহণ করেন।
নয়.
হযরত উম্মে হাবিবা রাঃ। মহানবী (সা:)- এর চাচা আবু সুফিয়ানের কন্যা তিনি । প্রথমে উবায়দুল্লাহ বিন জাহালের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। দু'জনই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং আফ্রিকার হাবশায় হিজরত করেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে উবায়দুল্লাহ খ্রিস্টান হয়ে যান। উবায়দুল্লাহ থেকে উম্মে হাবিবাকে মুক্ত করতে তিনি হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশির মাধ্যমে চাচাতো বোন উম্মে হাবিবা রাঃ-কে বিয়ে করেন।
দশ.
হযরত সাফিয়া রাঃ। তিনি ছিলেন নবীদেরই বংশধর। হযরত মুসা আ.- এর ভাই হযরত হারুন আ.- এর অধস্তন বংশধারার কন্যা। প্রথমে কিনানা ইবনে আবিলের স্ত্রী ছিলেন তিনি। কিনানার মৃত্যুর পর মহানবী (সা:)- এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
এগারো.
হযরত মায়মুনা রাঃ। তিনি প্রথমে মাসউদ বিন ওমরের স্ত্রী ছিলেন। সে তালাক দিলে আবু রিহামের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। আবু রিহাম মারা যাওয়ার পর মহানবী (সা:)- এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:)- এর এত বেশি বিয়ে আজকের যুগে অস্বাভাবিক মনে হলেও তৎকালীন আরব জগতে এটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। এ ছাড়া আগের নবীদের ইতিহাসে দেখা যায়, হযরত সুলায়মান আ.- এর ৭০০ স্ত্রী ছিল, হযরত দাউদ আ.- এর ৯৯ জন এবং হযরত ইবরাহীম আ.- এর তিনজন ও হযরত ইয়াকুব আ.- এর চারজন অবশেষে হযরত মুসা আ.- এর চারজন স্ত্রী ছিলেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা:) - এর বিয়ে প্রায় সবগুলোই মানবিক রূপে, এবং কুরআনের একটি আয়াতের বাস্তবায়ন, অথবা ইসলামী শরীয়ায় দু-একটি হুকুম বাস্তবায়ন। এঁদের কেউ ছিলেন মহানবী (সা:)- এর বৃহত্তর পরিবারের সদস্য, ফুফাতো বোন অথবা চাচাতো বোন। অনেক বিধবা-অসহায় নারীকে তিনি নিজ স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করেছেন। একজন বাদে কেউই কুমারী ছিলেন না, বরং মহানবী (সা:)- এর সঙ্গে অনেকের বিয়ে হয়েছিল, যাঁদের অনেক সন্তান ছিল, তা নিয়েই।
নবী (সা:)- এর এসব বিয়ের মধ্যে কোনো শারীরিক চাহিদাও ছিল না। বরং বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে তিনি বিয়ের মাধ্যমে একটি শক্তি সমাবেশও করে থাকবেন, যা দেখে তৎকালীন কাফের-মুশরিকরাও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল। ইসলামী শরীয়ায় এ জন্য শারীরিক প্রয়োজনে অধিক স্ত্রী রাখার প্রবণতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সীমারেখায় অনধিক চার স্ত্রী থাকলেও সবার অধিকার আদায় না করতে পারলে তাকে অন্যায় ও জুলুম বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
নবীজির সন্তান সমূহ:
নবী মুহাম্মদ (সা:) এর সন্তান মোট সাতজন মতান্তরে আটজন। হযরত খাদিজার রাঃ-এর গর্ভে ছয়জন সন্তান আবার কেউ বলেছেন সাতজন জন্মগ্রহণ করেন এঁদের মধ্যে চার জন মেয়ে এবং দুইজন বা তিনজন ছেলে। আর হযরত মারিয়া কিবতিয়া রাঃ-এর গর্ভজাত একজন পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেন তিনি হচ্ছেন, ইবরাহীম।
পুত্র
এক. হযরত কাসেম (তাঁর নামানুসারে মহানবী (সা:)- এর উপনাম রাখা হয়েছিল আবুল কাসেম)।
দুই. তাহের (অনেক ঐতিহাসিকগণ বলেছেন, তাঁর নাম ছিল আবদুল্লাহ)।
তিন. ইবরাহীম। (তিনি ছিলেন মারিয়া কিবতিয়া রাঃ-এর গর্ভজাত সন্তান)।
কন্যা:
এক. ফাতিমা, দুই. জয়নাব, তিন. রুকাইয়া, চার. উম্মে কুলছুম।
ইবরাহীম ছাড়া উল্লিখিত সন্তানদের সবাই ছিলেন খাদিজা রাঃ-এর গর্ভজাত। মুহাম্মদ (সা:)- এর এই তিন পুত্রসন্তানের সবাই শৈশবে মারা যান। তবে কাসেম সওয়ারিতে আরোহণ করতে পারতেন, এমন বয়সেই মৃত্যুবরণ করেন।
নবুয়ত-পূর্ব জীবন:
আরবদের মধ্যে বিদ্যমান হিংস্রতা, খেয়ানতপ্রবণতা এবং প্রতিশোধস্পৃহা দমনের জন্যই হিলফুল ফুজুল নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। মোহাম্মাদ এতে যোগদান করেন এবং এই সংঘকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি বিরাট ভূমিকা রাখেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় তরুণ বয়সে মোহাম্মাদের তেমন কোন পেশা ছিলনা। তবে তিনি বকরি চড়াতেন বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। সাধারণত তিনি যে বকরিগুলো চড়াতেন সেগুলো ছিল বনি সা'দ গোত্রের। কয়েক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি মক্কায় বসবাসরত বিভিন্ন ব্যক্তির বকরিও চড়াতেন। এরপর তিনি ব্যবসা শুরু করেন। মোহাম্মাদ অল্প সময়ের মধ্যেই একাজে ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। এতই খ্যাতি তিনি লাভ করেন যে, তার উপাধি হয়ে যায় আল আমিন এবং আল সাদিক যেগুলোর বাংলা অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে বিশ্বস্ত এবং সত্যবাদী। ব্যবসা উপলক্ষ্যে তিনি সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে বেশ কয়েকবার সফর করেন। মোহাম্মাদের সুখ্যাতি যখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ তা অবহিত হয়েই তাকে নিজের ব্যবসার জন্য সফরে যাবার অনুরোধ জানান। যুবক মোহাম্মাদ এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং খাদীজার পণ্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত যান।
যুবক মোহাম্মাদের বয়স যখন ৩৫ বছর তখন কা'বা গৃহের পুনর্নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বেশ কয়েকটি কারণে কাবা গৃহের সংস্কার কাজ শুরু হয়। পুরনো ইমারত ভেঙ্গে ফেলে নতুন করে তৈরি করা শুরু হয়। এভাবে পুনর্নির্মাণের সময় যখন হাজরে আসওয়াদ (পবিত্র কালো পাথর) পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয় তখনই বিপত্তি দেখা দেয়। মূলত কোন গোত্রের লোক এই কাজটি করবে তা নিয়েই ছিল কোন্দল। নির্মাণকাজ সব গোত্রের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হাজরে আসওয়াদ স্থাপন ছিল একজনের কাজ। কে স্থাপন করবে এ নিয়ে বিবাদ শুরু হয় এবং চার-পাঁচ দিন যাবত এ বিবাদ অব্যাহত থাকার এক পর্যায়ে এটি এমনই মারাত্মক রূপ ধারণ করে যে হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় আবু উমাইয়া মাখজুমি একটি সমাধান নির্ধারণ করে যে পরদিন প্রত্যুষে মসজিদে হারামের দরজা দিয়ে যে প্রথম প্রবেশ করবে তার সিদ্ধান্তই সবাই মেনে নেবে। পরদিন মোহাম্মাদ সবার প্রথমে কাবায় প্রবেশ করেন। এতে সবাই বেশ সন্তুষ্ট হয় এবং তাকে বিচারক হিসেবে মেনে নেয়। আর তার প্রতি সবার সুগভীর আস্থাও ছিল। যা হোক এই দায়িত্ব পেয়ে মোহাম্মাদ অত্যন্ত সুচারুভাবে ফয়সালা করেন। তিনি একটি চাদর বিছিয়ে তার উপর নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ রাখেন এবং বিদ্যমান প্রত্যেক গোত্রের নেতাদের ডেকে তাদেরকে চাদরের বিভিন্ন কোণা ধরে যথাস্থানে নিয়ে যেতে বলেন এবং তারা তা ই করে। এরপর তিনি পাথর উঠিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করেন।
নবুওয়ত প্রাপ্তি:
চল্লিশ বছর বয়সে নবী মুহাম্মাদ (সা:) নবুয়ত লাভ করেন, অর্থাৎ এই সময়েই স্রষ্টা তার কাছে ওহী প্রেরণ করেন। নবুয়ত সম্বন্ধে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় আজ-জুহরির বর্ণনায়। জুহরি বর্ণিত হাদীস অনুসারে নবী সত্য দর্শনের মাধ্যমে ওহী লাভ করেন। ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর নবী প্রায়ই মক্কার অদূরে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন। তাঁর স্ত্রী খাদিজা নিয়মিত তাঁকে খাবার দিয়ে আসতেন। এমনি এক ধ্যানের সময় ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল আ. তাঁর কাছে আল্লাহ প্রেরিত ওহী নিয়ে আসেন। জিবরাঈল তাঁকে এই পঙক্তি (কুরআনের আয়াত, সুরা আলাক্ব-এর) কটি পড়তে বলেন:
যার অর্থ-
'পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।' - সুরা আলাক্ব
উত্তরে নবী জানান যে তিনি পড়তে জানেন না, এতে জিবরাঈল আ. তাকে জড়িয়ে ধরে প্রবল চাপ প্রয়োগ করেন এবং আবার একই পঙক্তি পড়তে বলেন। কিন্তু এবারও মোহাম্মাদ নিজের অপারগতার কথা প্রকাশ করেন। এভাবে তিনবার চাপ দেয়ার পর মোহাম্মাদ পঙক্তিটি পড়তে সমর্থ হন। অবতীর্ণ হয় কুরআনের প্রথম আয়াত গুচ্ছ; সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত। প্রথম অবতরণের পর নবী এতই ভীত হয়ে পড়েন যে কাঁপতে নিজ গৃহে প্রবেশ করেই খাদিজাকে কম্বল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে দেয়ার জন্য বলেন। বারবার বলতে থাবেন, "আমাকে আবৃত কর"। নওফেল তাঁকে শেষ নবী হিসেবে আখ্যায়িত করে। ধীরে আত্মস্থ হন নবী। তারপর আবার অপেক্ষা করতে থাকেন পরবর্তী প্রত্যাদেশের জন্য। একটি লম্বা বিরতির পর তাঁর কাছে দ্বিতীয় বারের মত ওহী আসে। এবার অবতীর্ণ হয় সূরা মুদ্দাস্সির-এর কয়েকটি আয়াত। এর পর থেকে গোপনে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন মোহাম্মাদ (সা:)। এই ইসলাম ছিল জীবনকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়ার জন্য প্রেরিত একটি আদর্শ ব্যবস্থা। তাই এর প্রতিষ্ঠার পথ ছিল খুবই বন্ধুর। এই প্রতিকূলতার মধ্যেই নবীর মক্কী জীবন শুরু হয়।
http://itibritto.com/hazrat-abu-bakr-ra/
Wikipedia
এই ঘটনার পরই হযরত হালিমা শিশু মুহাম্মাদকে মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। ছয় বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের সাথে কাটান। এই সময় একদিন মা আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদিনায় যাবেন। সম্ভবত কোনো আত্মীয়ের সাথে দেখা করা এবং স্বামীর কবর জিয়ারত করাই এর কারণ ছিল। মা আমিনা ছেলে, শ্বশুর এবং দাসী উম্মে আয়মনকে নিয়ে ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদিনায় পৌঁছেন। তিনি মদিনায় একমাস সময় অতিবাহিত করেন। একমাস পর মক্কায় ফেরার পথে আরওয়া নামক স্থানে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই দাফন করা হয়। মাতার মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মুত্তালিব শিশু মুহাম্মাদকে নিয়ে ধীরে মক্কায় পৌঁছেন। এর পর থেকে দাদাই মুহাম্মাদের দেখাশোনা করতে থাকেন। মুহাম্মদের বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন তখন তার দাদাও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মৃত্যুর আগে তিনি তার পুত্র আবু তালিবকে ডেকে নাতি শিশু মুহাম্মদের দায়িত্বভার দিয়ে যান।
চাচা আবু তালিব ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার সিরিয়া সফরে যেতেন। মুহাম্মাদের বয়স যখন ১২ বছর তখন তিনি চাচার সাথে সিরিয়া যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেন। প্রগাঢ় মমতার কারণে আবু তালিব আর নিষেধ করতে পারলেন না। যাত্রাপথে বসরা পৌঁছার পর কাফেলাসহ আবু তালিব তাঁবু ফেললেন। সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল। শহরটিতে জারজিস নামে এক খ্রিস্টান পাদ্রী ছিলেন যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি তার গির্জা হতে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারী করেন। এ সময় তিনি বালক মুহাম্মাদকে দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেন। ফুজারের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন নবীর বয়স ১৫ বছর। এই যুদ্ধে তিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। কিন্তু তাঁর কিছু করার ছিল না। সে সময় থেকেই তিনি কিছু একটি করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন।
বিবাহ ও নবীপত্নীগণ: মক্কা থেকে মদিনায় ইতিহাসখ্যাত হিজরতের মাত্র তিন বছর আগে হযরত খাদিজা রাঃ এর ইন্তেকাল হয়। এ সময় নবী করিম (সা:) এর বয়স ছিল ৪৯ বছর। হযরত খাদিজা রাঃ এর মৃত্যু পর্যন্ত তিনিই ছিলেন নবীজি (সা:) এর একমাত্র স্ত্রী। হযরত খাদিজা রাঃ এর মৃত্যুর পর তিনি একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করেন। এঁদের অনেকেই ছিলেন বিধবা বা যুদ্ধে স্বামীহারা অথবা স্বামী পরিত্যক্তা কিংবা দুস্থ। আবার কোনো বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় আল্লাহর সরাসরি নির্দেশে। উম্মাহাতে মু'মিনিনরা হলেন-
এক.
হযরত খাদীজা মাইছারার মুখে মুহাম্মাদের সততা ও ন্যায়পরায়ণতার ভূয়সী প্রশংসা শুনে অভিভূত হন। এছাড়া ব্যবসায়ের সফলতা দেখে তিনি তার যোগ্যতা সম্বন্ধেও অবহিত হন। এক পর্যায়ে তিনি মুহাম্মাদকে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি স্বীয় বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনব্বিহরের কাছে বিয়ের ব্যপারে তার মনের কথা ব্যক্ত করেন। নাফিসার কাছে শুনে মুহাম্মাদ বলেন যে তিনি তার অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানাবেন। মুহাম্মাদ তাঁর চাচাদের সাথে কথা বলে বিয়ের সম্মতি জ্ঞাপন করেন। বিয়ের সময় খাদীজার বয়স ছিল ৪০ আর মুহাম্মাদের বয়স ছিল ২৫। তিনিই ছিলেন নবী করিম (সা:)- এর প্রথম স্ত্রী। তিনি বিধবা তবে বিদুষী ও অভিজাত নারী ছিলেন। পবিত্র মক্কায় তিনি 'ত্বাহেরা'— অর্থাৎ পবিত্র নারী বলে পরিচিত ছিলেন। নবী করিম (সা:)- এর চেয়ে কমপক্ষে ১৫ বছরের বড় ছিলেন তিনি। নবুয়তের প্রথম জীবনে নবী (সা:)- এর দাওয়াতের কাজে তিনি বিশেষভাবে পাশে দাঁড়ান।
দুই.
হযরত সাওদা বিনতে জামআ রাঃ প্রথমে সাকরান ইবনে আমরের স্ত্রী ছিলেন। সাকরানের মৃত্যুর পর নবী (সা:)- এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
তিন.
হযরত আয়েশা রাঃ যিনি ছিলেন মুসলিম বিশ্বের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর রাঃ-এর কন্যা। কেবল হযরত আয়েশা রাঃ-ই কুমারী মেয়ে ছিলেন, যাঁদের সঙ্গে মহানবী (সা:)- এর বিয়ে হয়েছিল। নবী (সা:)- এর ওফাতের সময় হযরত আয়েশা রাঃ-এর বয়স ছিল মাত্র আঠারো বছর। নবী (সা:)- এর বহু হাদিস হযরত আয়েশা রাঃ-এর মাধ্যমে মানবজাতির কাছে পৌঁছেছে। তাঁর প্রখর মেধা ও স্মরণশক্তি এ কাজে সহায়ক হয়েছিল।
চার.
হযরত হাফসা রাঃ ছিলেন মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় খলিফা এবং অর্ধ জাহানের বাদশা হযরত ওমর রাঃ-এর কন্যা। হযরত হাফসা রাঃ প্রথম জীবনে হযরত উনাইস ইবনে হুজাইফা রাঃ-এর স্ত্রী ছিলেন। হযরত উনাইস রাঃ যুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর নবী (সা:) তাঁকে স্ত্রী হিসেবে বরণ করেন।
পাঁচ.
হযরত জয়নব বিনতে খুজাইমা রাঃ। তিনি মদিনায় নিঃস্বদের জননী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রথম জীবনে তাঁর বিয়ে হয়েছিল তোফায়েল ইবনে হারিছের সঙ্গে। তালাকপ্রাপ্ত হয়ে তোফায়েলেরই ভাই উবায়দাকে বিয়ে করেন তিনি। উহুদের যুদ্ধে উবায়দা শহীদ হন। পরে অসহায় জয়নবকে বিয়ে করেন নবী করীম (সা:)। কিন্তু বিবাহিত জীবনের ছয় মাসের মধ্যেই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায়।
ছয়.
হযরত উম্মে সালামা রাঃ। প্রথম জীবনে তাঁর বিয়ে হয়েছিল আবু সালামা রাঃ-এর সঙ্গে। উহুদের যুদ্ধে আবু সালামা রাঃ শহীদ হন। বিধবা উম্মে সালামাকে অবশেষে নবী (সা:) স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে নেন। ইতিহাসবিদরা বলেন, নবী (সা:)- এর স্ত্রীদের মধ্যে তিনিই সবার শেষে মৃত্যুবরণ করেন।
সাত.
হযরত জয়নাব বিনতে জাহাশ রাঃ। তিনি ছিলেন নবী (সা:)- এর ফুফাতো বোন। নবী (সা:) প্রথমে তাঁর এই বোনকে তাঁর পালকপুত্র হযরত জায়েদ রাঃ-এর সঙ্গে বিয়ে দেন। এই বিয়েতে গোড়া থেকেই জয়নাব রাঃ-এর আপত্তি ছিল। ফলে তাঁদের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। পরে তাঁদের পারিবারিক জীবনে বিচ্ছেদ ঘটে। হযরত জয়নাব রাঃ-এর আপত্তিতে এ বিয়ে সংঘটিত হওয়ায় এবং পরে বিচ্ছেদ ঘটায় নবী (সা:)- এর মনে কিছুটা অনুশোচনা আসে। এ থেকে জয়নাব রাঃ-কে নিজে বিয়ে করার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেও তৎকালীন আরবের কুসংস্কারের জন্য তা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। পরে পবিত্র কুরআনের সুরা আহযাবে আয়াত নাজিল হয়। সেখানে পালক ছেলে ও ঔরসজাত সন্তান সমতুল্য নয় বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কুসংস্কার নির্মূল করার উদ্দেশ্যে নবী (সা:)- এর মাধ্যমে সেই বিধান বাস্তবায়ন করে দেখানোর প্রয়োজন অনুভূত হয়। তখনই হযরত জয়নাব রাঃ-এর সঙ্গে নবী (সা:)- এর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
আট.
হযরত জুয়াইরিয়া রাঃ। তিনি একজন আরব গোত্রের সরদার হারিছের কন্যা ছিলেন। যুদ্ধে বন্দিনী হয়ে আসেন। মহানবী (সা:) যুদ্ধবন্দির সঙ্গে বিবাহে আবদ্ধ হন। উপহার হিসেবে গোত্রের সব বন্দি মুক্তি লাভ করে। তাঁর পিতা হারিছও ইসলাম গ্রহণ করেন।
নয়.
হযরত উম্মে হাবিবা রাঃ। মহানবী (সা:)- এর চাচা আবু সুফিয়ানের কন্যা তিনি । প্রথমে উবায়দুল্লাহ বিন জাহালের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। দু'জনই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং আফ্রিকার হাবশায় হিজরত করেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে উবায়দুল্লাহ খ্রিস্টান হয়ে যান। উবায়দুল্লাহ থেকে উম্মে হাবিবাকে মুক্ত করতে তিনি হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশির মাধ্যমে চাচাতো বোন উম্মে হাবিবা রাঃ-কে বিয়ে করেন।
দশ.
হযরত সাফিয়া রাঃ। তিনি ছিলেন নবীদেরই বংশধর। হযরত মুসা আ.- এর ভাই হযরত হারুন আ.- এর অধস্তন বংশধারার কন্যা। প্রথমে কিনানা ইবনে আবিলের স্ত্রী ছিলেন তিনি। কিনানার মৃত্যুর পর মহানবী (সা:)- এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
এগারো.
হযরত মায়মুনা রাঃ। তিনি প্রথমে মাসউদ বিন ওমরের স্ত্রী ছিলেন। সে তালাক দিলে আবু রিহামের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। আবু রিহাম মারা যাওয়ার পর মহানবী (সা:)- এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:)- এর এত বেশি বিয়ে আজকের যুগে অস্বাভাবিক মনে হলেও তৎকালীন আরব জগতে এটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। এ ছাড়া আগের নবীদের ইতিহাসে দেখা যায়, হযরত সুলায়মান আ.- এর ৭০০ স্ত্রী ছিল, হযরত দাউদ আ.- এর ৯৯ জন এবং হযরত ইবরাহীম আ.- এর তিনজন ও হযরত ইয়াকুব আ.- এর চারজন অবশেষে হযরত মুসা আ.- এর চারজন স্ত্রী ছিলেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা:) - এর বিয়ে প্রায় সবগুলোই মানবিক রূপে, এবং কুরআনের একটি আয়াতের বাস্তবায়ন, অথবা ইসলামী শরীয়ায় দু-একটি হুকুম বাস্তবায়ন। এঁদের কেউ ছিলেন মহানবী (সা:)- এর বৃহত্তর পরিবারের সদস্য, ফুফাতো বোন অথবা চাচাতো বোন। অনেক বিধবা-অসহায় নারীকে তিনি নিজ স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করেছেন। একজন বাদে কেউই কুমারী ছিলেন না, বরং মহানবী (সা:)- এর সঙ্গে অনেকের বিয়ে হয়েছিল, যাঁদের অনেক সন্তান ছিল, তা নিয়েই।
নবী (সা:)- এর এসব বিয়ের মধ্যে কোনো শারীরিক চাহিদাও ছিল না। বরং বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে তিনি বিয়ের মাধ্যমে একটি শক্তি সমাবেশও করে থাকবেন, যা দেখে তৎকালীন কাফের-মুশরিকরাও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল। ইসলামী শরীয়ায় এ জন্য শারীরিক প্রয়োজনে অধিক স্ত্রী রাখার প্রবণতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সীমারেখায় অনধিক চার স্ত্রী থাকলেও সবার অধিকার আদায় না করতে পারলে তাকে অন্যায় ও জুলুম বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
নবীজির সন্তান সমূহ:
নবী মুহাম্মদ (সা:) এর সন্তান মোট সাতজন মতান্তরে আটজন। হযরত খাদিজার রাঃ-এর গর্ভে ছয়জন সন্তান আবার কেউ বলেছেন সাতজন জন্মগ্রহণ করেন এঁদের মধ্যে চার জন মেয়ে এবং দুইজন বা তিনজন ছেলে। আর হযরত মারিয়া কিবতিয়া রাঃ-এর গর্ভজাত একজন পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেন তিনি হচ্ছেন, ইবরাহীম।
পুত্র
এক. হযরত কাসেম (তাঁর নামানুসারে মহানবী (সা:)- এর উপনাম রাখা হয়েছিল আবুল কাসেম)।
দুই. তাহের (অনেক ঐতিহাসিকগণ বলেছেন, তাঁর নাম ছিল আবদুল্লাহ)।
তিন. ইবরাহীম। (তিনি ছিলেন মারিয়া কিবতিয়া রাঃ-এর গর্ভজাত সন্তান)।
কন্যা:
এক. ফাতিমা, দুই. জয়নাব, তিন. রুকাইয়া, চার. উম্মে কুলছুম।
ইবরাহীম ছাড়া উল্লিখিত সন্তানদের সবাই ছিলেন খাদিজা রাঃ-এর গর্ভজাত। মুহাম্মদ (সা:)- এর এই তিন পুত্রসন্তানের সবাই শৈশবে মারা যান। তবে কাসেম সওয়ারিতে আরোহণ করতে পারতেন, এমন বয়সেই মৃত্যুবরণ করেন।
নবুয়ত-পূর্ব জীবন:
আরবদের মধ্যে বিদ্যমান হিংস্রতা, খেয়ানতপ্রবণতা এবং প্রতিশোধস্পৃহা দমনের জন্যই হিলফুল ফুজুল নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। মোহাম্মাদ এতে যোগদান করেন এবং এই সংঘকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি বিরাট ভূমিকা রাখেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় তরুণ বয়সে মোহাম্মাদের তেমন কোন পেশা ছিলনা। তবে তিনি বকরি চড়াতেন বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। সাধারণত তিনি যে বকরিগুলো চড়াতেন সেগুলো ছিল বনি সা'দ গোত্রের। কয়েক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি মক্কায় বসবাসরত বিভিন্ন ব্যক্তির বকরিও চড়াতেন। এরপর তিনি ব্যবসা শুরু করেন। মোহাম্মাদ অল্প সময়ের মধ্যেই একাজে ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। এতই খ্যাতি তিনি লাভ করেন যে, তার উপাধি হয়ে যায় আল আমিন এবং আল সাদিক যেগুলোর বাংলা অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে বিশ্বস্ত এবং সত্যবাদী। ব্যবসা উপলক্ষ্যে তিনি সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে বেশ কয়েকবার সফর করেন। মোহাম্মাদের সুখ্যাতি যখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ তা অবহিত হয়েই তাকে নিজের ব্যবসার জন্য সফরে যাবার অনুরোধ জানান। যুবক মোহাম্মাদ এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং খাদীজার পণ্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত যান।
যুবক মোহাম্মাদের বয়স যখন ৩৫ বছর তখন কা'বা গৃহের পুনর্নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বেশ কয়েকটি কারণে কাবা গৃহের সংস্কার কাজ শুরু হয়। পুরনো ইমারত ভেঙ্গে ফেলে নতুন করে তৈরি করা শুরু হয়। এভাবে পুনর্নির্মাণের সময় যখন হাজরে আসওয়াদ (পবিত্র কালো পাথর) পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয় তখনই বিপত্তি দেখা দেয়। মূলত কোন গোত্রের লোক এই কাজটি করবে তা নিয়েই ছিল কোন্দল। নির্মাণকাজ সব গোত্রের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হাজরে আসওয়াদ স্থাপন ছিল একজনের কাজ। কে স্থাপন করবে এ নিয়ে বিবাদ শুরু হয় এবং চার-পাঁচ দিন যাবত এ বিবাদ অব্যাহত থাকার এক পর্যায়ে এটি এমনই মারাত্মক রূপ ধারণ করে যে হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় আবু উমাইয়া মাখজুমি একটি সমাধান নির্ধারণ করে যে পরদিন প্রত্যুষে মসজিদে হারামের দরজা দিয়ে যে প্রথম প্রবেশ করবে তার সিদ্ধান্তই সবাই মেনে নেবে। পরদিন মোহাম্মাদ সবার প্রথমে কাবায় প্রবেশ করেন। এতে সবাই বেশ সন্তুষ্ট হয় এবং তাকে বিচারক হিসেবে মেনে নেয়। আর তার প্রতি সবার সুগভীর আস্থাও ছিল। যা হোক এই দায়িত্ব পেয়ে মোহাম্মাদ অত্যন্ত সুচারুভাবে ফয়সালা করেন। তিনি একটি চাদর বিছিয়ে তার উপর নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ রাখেন এবং বিদ্যমান প্রত্যেক গোত্রের নেতাদের ডেকে তাদেরকে চাদরের বিভিন্ন কোণা ধরে যথাস্থানে নিয়ে যেতে বলেন এবং তারা তা ই করে। এরপর তিনি পাথর উঠিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করেন।
নবুওয়ত প্রাপ্তি:
চল্লিশ বছর বয়সে নবী মুহাম্মাদ (সা:) নবুয়ত লাভ করেন, অর্থাৎ এই সময়েই স্রষ্টা তার কাছে ওহী প্রেরণ করেন। নবুয়ত সম্বন্ধে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় আজ-জুহরির বর্ণনায়। জুহরি বর্ণিত হাদীস অনুসারে নবী সত্য দর্শনের মাধ্যমে ওহী লাভ করেন। ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর নবী প্রায়ই মক্কার অদূরে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন। তাঁর স্ত্রী খাদিজা নিয়মিত তাঁকে খাবার দিয়ে আসতেন। এমনি এক ধ্যানের সময় ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল আ. তাঁর কাছে আল্লাহ প্রেরিত ওহী নিয়ে আসেন। জিবরাঈল তাঁকে এই পঙক্তি (কুরআনের আয়াত, সুরা আলাক্ব-এর) কটি পড়তে বলেন:
যার অর্থ-
'পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।' - সুরা আলাক্ব
উত্তরে নবী জানান যে তিনি পড়তে জানেন না, এতে জিবরাঈল আ. তাকে জড়িয়ে ধরে প্রবল চাপ প্রয়োগ করেন এবং আবার একই পঙক্তি পড়তে বলেন। কিন্তু এবারও মোহাম্মাদ নিজের অপারগতার কথা প্রকাশ করেন। এভাবে তিনবার চাপ দেয়ার পর মোহাম্মাদ পঙক্তিটি পড়তে সমর্থ হন। অবতীর্ণ হয় কুরআনের প্রথম আয়াত গুচ্ছ; সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত। প্রথম অবতরণের পর নবী এতই ভীত হয়ে পড়েন যে কাঁপতে নিজ গৃহে প্রবেশ করেই খাদিজাকে কম্বল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে দেয়ার জন্য বলেন। বারবার বলতে থাবেন, "আমাকে আবৃত কর"। নওফেল তাঁকে শেষ নবী হিসেবে আখ্যায়িত করে। ধীরে আত্মস্থ হন নবী। তারপর আবার অপেক্ষা করতে থাকেন পরবর্তী প্রত্যাদেশের জন্য। একটি লম্বা বিরতির পর তাঁর কাছে দ্বিতীয় বারের মত ওহী আসে। এবার অবতীর্ণ হয় সূরা মুদ্দাস্সির-এর কয়েকটি আয়াত। এর পর থেকে গোপনে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন মোহাম্মাদ (সা:)। এই ইসলাম ছিল জীবনকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়ার জন্য প্রেরিত একটি আদর্শ ব্যবস্থা। তাই এর প্রতিষ্ঠার পথ ছিল খুবই বন্ধুর। এই প্রতিকূলতার মধ্যেই নবীর মক্কী জীবন শুরু হয়।
নবী মুহাম্মাদ (সা:) এর জীবনী -জন্ম, বংশ পরিচয় ও পরিবার, শৈশবকাল (P-I) সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- নবী মুহাম্মাদ (সা:) এর জীবনী -কৈশরকাল, পারিবারিক জীবন, নওবুয়ত (P-II) সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- নবী মুহাম্মাদ (সা:) এর জীবনী -মক্কী জীবন তথা ইসলাম প্রচার, ইসলামের দাওয়াত ও তায়েফ গমন (P-III) সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- নবী মুহাম্মাদ (সা:) এর জীবনী -মদিনায় হিজরত ও মাদানী জীবন, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও শাসননীতি, মক্কা বিজয় ও বিদায় হজ ও ঐতিহাসিক ভাষণ এবং নবীজি (সা:)- এর ওফাত (P-IV) সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- নবী মুহাম্মাদ (সা:) এর জীবনী - রাসূল (ছাঃ)- এর উপরে কাফিরদের নির্যাতন (P-V) সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন।
http://itibritto.com/hazrat-abu-bakr-ra/
Wikipedia
No comments:
Post a Comment